আপনি কি প্রস্তুত?


রাত্রিকাল। চারিদিক নীরব এবং ঘন অন্ধকার। রাত্রির এই নীরবতা ভঙ্গ করে একটি নৈশ কোচের গর্জন শোনা গেল। অসতর্কভাবে বাসটি একটি ব্রিজের উপর উঠতেই বাসের একটি টায়ার বিকট শব্দে ফেটে গেল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি ব্রিজের রেলিং এ সজোরে ধাক্কা খেল এবং রেলিংটা ভেঙে নিচে অন্ধকার পানিতে নিমজ্জিত হলো। শুধু কয়েক মিনিটের ব্যবধান, এর মধ্যেই বাসটির অর্ধেকেরও বেশি যাত্রী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।


এরকম ঘটনা জীবনের অনিশ্চয়তাকে মেনে নিতে আমাদের বাধ্য করে। আমরা আমাদের মৃত্যু-চিন্তা এড়ানোর চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু এটাই আমাদের জীবনের চরম বাস্তবতা, যার সম্মুখীন আমাদের সবাইকে হতে হয়। আমরা কেউই জানি না, আগামীকাল পর্যন্ত আমরা বাঁচবো কিনা। এরপর আসে এমন কিছু, যা আরও ভয়ঙ্কর ও অনিশ্চিত, আর সেটা হলো আল্লাহ্‌র বিচার-পরবর্তী বেহেস্ত বা দোজখও

সেই ভয়ঙ্কর দিন সম্বন্ধে আমরা যদি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির কিছুমাত্র নিশ্চয়তা পেতাম, তাহলে কী শান্তিই না পেতাম! সেই দিনে আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া এবং সম্মানিত হওয়াটা যে কত বড় প্রাপ্তি, তা কেউ ভাবতেও পারে না । কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? বিস্ময়ের কথা, কোরআন শরীফে এমন একজনের কথা বলা হয়েছে, যিনি সেই ভয়ঙ্কর দিনে আল্লাহ্‌র দ্বারা সম্মানিত হবেন। কোরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ

إِذْ قَالَتِ الْمَلآئِكَةُ يَا مَرْيَمُ إِنَّ اللّهَ يُبَشِّرُكِ بِكَلِمَةٍ مِّنْهُ اسْمُهُ الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ وَجِيهًا فِي الدُّنْيَاوَالآخِرَةِ وَمِنَ الْمُقَرَّبِينَ
স্মরণ কর, যখন ফিরিশতাগণ বলিল, ‘হে মর্‌ইয়াম! নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তোমাকে তাঁহার পক্ষ হইতে একটি কালেমার সুসংবাদ দিতেছেন। তাহার নাম মসীহ্‌ মার্‌ইয়াম তনয় ‘ঈসা, সে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত এবং সান্নিধ্যপ্রাপ্তগণের অন্যতম হইবে। সুরা আলে ইমরান ৩:৪৫ আয়াত।

সম্মানিত –দুনিয়া ও আখিরাতে! আশ্চর্য! কোরআন এই কথা আর করোও সম্পর্কে বলেনি। তিনি কেন এরকম সম্মানের জন্য মনোনীত হয়েছেন? তাঁর জীবন পর্যালোচনা করাটা আমাদের জন্য একটি যথাকর্তব্য হবে। আল্লাহ্‌ তাঁকে যেভাবে সম্মানিত করেছেন সেটা আমরা যত ভালোভাবে বুঝতে পারবো, তত বেশি করে আমরা এরকম সম্মান লাভের সুযোগ পাব। আসুন, সংক্ষেপে একবার ঈসা নবীর জীবনীটা দেখা যাক।
প্রথমে, আমরা দেখি যে, আল্লাহ্‌পাক আগে থেকেই এরকম একটি শিশুর মা-কে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। বিবি মরিয়ম সম্পর্কে কোরআন শরীফে আমাদের বলেঃ

وَإِذْ قَالَتِ الْمَلاَئِكَةُ يَا مَرْيَمُ إِنَّ اللّهَ اصْطَفَاكِ وَطَهَّرَكِ وَاصْطَفَاكِ عَلَى نِسَاء الْعَالَمِينَ
স্মরণ কর, যখন ফিরিশতাগণ বলিয়াছিল, ‘হে মার্‌ইয়াম! আল্লাহ্‌ তোমাকে মনোনীত ও পবিত্র করিয়াছেন এবং বিশ্বের নারীগণের মধ্যে তোমাকে মনোনীত করিয়াছেন।’ সুরা আলে ইমরান ৩: ৪২ আয়াত।

কী বিস্ময়কর বর্ণনা। বিশ্বের সমস্ত নারীগণের মধ্যে আল্লাহ্‌ মরিয়মকে মনোনীত করছেন। তথাপিও, ঈসা (আঃ) মা যে শুধু অদ্বিতীয়াই ছিলেন তাই-ই নয়, ঈসার জন্মও অদ্বিতীয় ছিল। অন্যদের জন্ম যেভাবে হয়, সেভাবে তাঁর জন্ম হয়নি। তিনি একজন কুমারী মেয়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।

فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُولٍ حَسَنٍ وَأَنبَتَهَا نَبَاتًا حَسَنًا وَكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيْهَا زَكَرِيَّا الْمِحْرَابَ وَجَدَعِندَهَا رِزْقاً قَالَ يَا مَرْيَمُ أَنَّى لَكِ هَـذَا قَالَتْ هُوَ مِنْ عِندِ اللّهِ إنَّ اللّهَ يَرْزُقُ مَن يَشَاء بِغَيْرِ حِسَابٍ
সে বলিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করে নাই, আমার সন্তান হইবে কীভাবে?’ তিনি বলিলেন, ‘এইভাবে’, আল্লাহ্‌ যাহা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। তিনি যখন কিছু স্থির করেন তখন বলেন, ‘হও’ এবং উহা হইয়া যায় । সুরা আলে ইমরান ৩:৪৭ আয়াত।

আল্লাহ্‌র কুদরতে অলৌকিকভাবে জন্ম হওয়ায়, কোরআন শরীফের বর্ণনামতে, অন্য আর কোন নবীকে ঈসার মতো পবিত্র বা পাক বলা হয়নি।

قَالَ إِنَّمَا أَنَا رَسُولُ رَبِّكِ لِأَهَبَ لَكِ غُلَامًا زَكِيًّا
সে বলিল, ‘আমি তো তোমার প্রতিপালক – প্রেরিত, তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করিবার জন্য।’ সুরা মার্‌ইয়াম ১৯:১৯ আয়াত।

অন্য সব মানুষ, এমকি মুসা এবং দাউদের মতো নবীরা পর্যন্ত তাঁদের পাপ ও ভুলের জন্য আল্লাহ্‌র সামনে অনুশোচনা বা তওবা করছেন (সুরা বাকারা ২:৩৭; সুরা হূদ ১১:৪৭; সুরা শু ‘আরা’ ২৬:৮২ সুরা কাসাস ২৮:১৬ সুরা সাফ্‌ফাত ৩৭:১৩৯-১৪৬; সুরা সাদ ৩৮:২৪-২৫)। কিন্তু, ঈসা সম্বন্ধে এমন ধরনের কোন অনুশোচনা বা তওবা কথা কোরআনে বর্ণিত হয়নি, কারণ অনুশোচনা করার মতো তাঁর কোন পাপ ছিল না।
তাঁর এই অলৌকিক জন্ম ছাড়াও, তাঁর জীবনটাও অবশ্য বিস্ময়কর ছিল। কোরআনে বর্ণত তাঁর কৃত অনেক মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনার মধ্যে নিচে কয়েকটি দেয়া হলোঃ

وَرَسُولاً إِلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنِّي قَدْ جِئْتُكُم بِآيَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ أَنِّي أَخْلُقُ لَكُم مِّنَ الطِّينِ كَهَيْئَةِ الطَّيْرِ فَأَنفُخُفِيهِ فَيَكُونُ طَيْرًا بِإِذْنِ اللّهِ وَأُبْرِىءُ الأكْمَهَ والأَبْرَصَ وَأُحْيِـي الْمَوْتَى بِإِذْنِ اللّهِ وَأُنَبِّئُكُم بِمَا تَأْكُلُونَوَمَا تَدَّخِرُونَ فِي بُيُوتِكُمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَةً لَّكُمْ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ
‘আমি তোমাদের প্রতিপালেকের পক্ষ হইতে তোমাদের নিকট নিদর্শন লইয়া আসিয়াছি। আমি তোমাদের জন্য কর্দম দ্বারা একটি পক্ষীসদৃশ আকৃতি গঠন করিব; অতঃপর উহাতে আমি ফুঁৎকার দিব; ফলে আল্লাহ্‌র হুকুমে উহা পাখী হইয়া যাইবে। আমি জন্মন্ধ ও কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে নিরাময় করিব এবং আল্লাহ্‌র হুকুমে মৃতকে জীবন্ত করিব।’ সুরা আলে ইমরান ৩:৪৯ আয়াত।

ঈসার জন্মই যে শুধু অলৌকিক ছিল তাই-ই নয়, এই দুনিয়া থেকে তাঁর বিদায় নেয়াটাও সমানভাবে অলৌকিক ছিল। আল্লাহ্‌ তাঁকে জীবিত অবস্থায় বেহেস্ত তুলে নিয়েছেন, সেখানে তিনি এখনও আছেন এবং যুগের শেষে আবার দুনিয়ায় ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছেন।

إِذْ قَالَ اللّهُ يَا عِيسَى إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ الَّذِينَ كَفَرُواْ وَجَاعِلُ الَّذِينَ اتَّبَعُوكَفَوْقَ الَّذِينَ كَفَرُواْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأَحْكُمُ بَيْنَكُمْ فِيمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ
যখন আল্লাহ্‌ বলিলেন, ‘হে ঈসা! আমি তোমার কাল পূর্ণ  করিতেছি এবং আমার নিকট তোমাকে তুলিয়া লইতেছি এবং যাহারা কুফরী করিয়াছে তাহাদের মধ্যে হইতে তোমাকে পবিত্র করিতেছি। আর তোমার অনুসারীগণকে কিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের উপর প্রাধান্য দিতেছি............’ সুরা আল ইমরান ৩:৫৫ আয়াত।

কোরাআন শরীফে অবশ্য তাঁকে কতকগুলো আশ্চর্য উপাধি দেয়া হয়েছে। তাঁকে বলা হয়েছে ‘মসীহ্‌’, অর্থাৎ আল্লাহ্‌র মনোনীত ব্যক্তি (সুরা আলে ইমরান ৩:৪৫, সুর নিসা ৪:১৭১)। তাঁকে আরও বলা হয়েছে ‘কালেমাতুল্লাহ্‌ বা আল্লাহ্‌র কালাম বা বাক্য’, যেহেতু তিনিই মানুষের সাথে আল্লাহ্‌র যোগাযোগের মাধ্যম (সুরা আলে ইমরান ৩:৩৯; সুরা নিসা ৪:১৭১; সুরা মার্‌ইয়াম ১৯:৩৪)। শেষে, তাঁর অলৌকিক জন্মের জন্য তাঁকে ‘রুহুল্লাহ্‌ বা আল্লাহ্‌র রুহ্‌ বা আল্লাহ্‌র আত্মা’ বলা হয়েছে (সুরা নিসা ৪:১৭১ আয়াত)। কিন্তু ঈসা সম্বন্ধে কোরাআন শরীফে সম্ভবত সবচেয়ে যে আশ্চর্য সত্যটি বর্ণিত হয়েছে তা হলো, মানুষের জন্য তিনি রহমত বা অনুগ্রহ হিসাবে প্রেরিত হয়েছিলেন। সুরা মার্‌ইয়াম ১৯:২১ আয়াতে একথা নিম্নোক্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ

قَالَتْ أَنَّى يَكُونُ لِي غُلَامٌ وَلَمْ يَمْسَسْنِي بَشَرٌ وَلَمْ أَكُ بَغِيًّا
قَالَ كَذَلِكِ قَالَ رَبُّكِ هُوَ عَلَيَّ هَيِّنٌ وَلِنَجْعَلَهُ آيَةً لِلنَّاسِ وَرَحْمَةً مِّنَّا وَكَانَ أَمْرًا مَّقْضِيًّا
মার্‌ইয়াম বলিল, ‘কেমন করিয়া আমার পুত্র হইবে যখন আমাকে কোন পুরুষ স্পর্শ করে নাই এবং আমি ব্যভিচারিণীও নহি?’ সে বলিল, ‘এইরূপই হইবে।’ তোমার প্রতিপালক বলিয়াছেন, ‘ইহা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং আমি উহাকে এইজন্য সৃষ্টি করিব যেন সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমার নিকট হইতে এক অনুগ্রহ; ইহা তো এক স্থিরীকৃত ব্যাপার।’ সুরা মার্‌ইয়াম ১৯:২০,২১ আয়াত।

আল্লাহ্‌ নিজের কাছ থেকে ঈসাকে মানব জাতির জন্য একটি রহমত বা অনুগ্রহ হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। ইঞ্জিল শরীফে এই একই কথা এভাবে বলা হয়েছেঃ
قَالَ كَذَلِكِ قَالَ رَبُّكِ هُوَ عَلَيَّ هَيِّنٌ وَلِنَجْعَلَهُ آيَةً لِلنَّاسِ وَرَحْمَةً مِّنَّا وَكَانَ أَمْرًا مَّقْضِيًّا
মুসার মধ্য দিয়ে শরীয়ত দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ঈসা মসীহের মধ্য দিয়ে রহমত ও সত্য এসেছে। ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১:১৭ আয়াত।

আল্লাহ্‌র রহমত সেই জিনিস যা আমাদের প্রত্যেকের জন্য অবশ্য প্রয়োজন।
রোজা, নামাজ বা যাকাতের ক্ষেত্রে কতবার যে মানুষ আল্লাহ্‌র আদেশ অমান্য করেছে, তা কে না জানে। তার পরেও, আমাদের আন্তরিক মনোভাবে ও অনুভূতিতে আমরা কত বারই-না অপরাধ করছি, যেমন, রাগ, ঈর্ষা, গর্ব,  স্বার্থপরতা পায়ই আমাদের অনুভূতি ও কাজ উভয়কেই নিয়ন্ত্রণ করে। এরকম মানুষ তাহলে ন্যায় ও পবিত্র আল্লাহ্‌র বিচারে কীভাবে টিকে থাকবে?
আল্লাহ্‌র রহমতই হচ্ছে আমাদের একমাত্র আশা তিনি করুণাময় ও রহমতকারী। তথাপিও, এই রহমত কীভাবে পাওয়া যাবে? সেটা বুঝতে হলে, আল্লাহ্‌র রহমত হিসেবে প্রেরিত ঈসার জীবনকে আমাদের অবশ্যই আরও ঘনিষ্ঠভাবে জানতে হবে।

আল্লাহ্‌র রহমত লাভের উপায়টি পূর্ণভাবে যাচাই ও অবগত হওয়ার ক্ষেত্রে দূরত্ব একটি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যাহাক ঈসার জীবন, শিক্ষা এবং শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ্‌র রহমত ও তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপনের উপায় সম্বন্ধে 

1 টি মন্তব্য: